ব্যবধান দূর করা: বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহর-গ্রাম বৈষম্য মোকাবেলা
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে: শহর ও গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। সরকারি নীতিমালা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভাবে সৃষ্ট এই বৈষম্য দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং অসমতা বাড়িয়ে তুলছে।
পরিকাঠামোগত বৈষম্য
শহর-গ্রাম বৈষম্যের সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক হল স্কুল পরিকাঠামোর মধ্যে প্রকট পার্থক্য। শহরের স্কুলগুলোতে প্রায়ই আধুনিক ভবন, উপযুক্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। অন্যদিকে, অনেক গ্রামীণ স্কুল জরাজীর্ণ কাঠামো, উপযুক্ত শৌচাগারের অভাব এবং অপর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ সুবিধার সাথে সংগ্রাম করছে। এই পরিকাঠামোগত ব্যবধান শুধুমাত্র শিক্ষার পরিবেশকেই প্রভাবিত করে না, বরং শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও ধরে রাখার হারকেও প্রভাবিত করে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন
সরকার বিভিন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে পেশাগত উন্নয়নের সুযোগের মান ও ঘনত্বে লক্ষণীয় বৈষম্য রয়েছে। শহরের শিক্ষকরা প্রায়ই কর্মশালা, সেমিনার এবং অব্যাহত শিক্ষা কর্মসূচিতে সহজে অংশগ্রহণ করতে পারেন। অন্যদিকে, গ্রামীণ শিক্ষকরা ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও সীমিত সম্পদের কারণে এই ধরনের সেশনে অংশগ্রহণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যা শিক্ষার মানের ব্যবধান বাড়িয়ে তোলে।
সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম ও সামগ্রিক বিকাশ
শহরের স্কুলগুলো সাধারণত খেলাধুলা, শিল্পকলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচি সহ বিস্তৃত সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম অফার করে। এই কার্যক্রমগুলো শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ স্কুলগুলো, প্রায়ই সীমিত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার কারণে অনুরূপ সুযোগ প্রদান করতে হিমশিম খায়। এই বৈষম্য শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বিকাশকেই নয়, বরং উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির বাজারে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে।
অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা ও সম্প্রদায়ের সমর্থন
শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা ও সম্প্রদায়ের সমর্থনের মাত্রা প্রায়ই উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন হয়। শহরের অভিভাবকরা, সাধারণত বেশি শিক্ষিত ও শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ায়, তাদের সন্তানদের শিক্ষায় বেশি সম্পৃক্ত থাকেন। গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে সাক্ষরতার হার কম এবং অর্থনৈতিক চাপ বেশি, সেখানে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা সীমিত হতে পারে। এই পার্থক্য শিক্ষার্থীদের প্রেরণা, হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করা এবং সামগ্রিক শিক্ষাগত কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
সম্পূরক শিক্ষণ সামগ্রীর প্রাপ্যতা
শহরের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই লাইব্রেরি, বইয়ের দোকান এবং পাঠ্যপুস্তকের বাইরের শিক্ষা সংক্রান্ত সম্পদে ভালো প্রবেশাধিকার পায়। গ্রামীণ এলাকায়, এই ধরনের সম্পূরক উপকরণ দুর্লভ, যা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শিক্ষণ সম্পদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ সীমিত করে। এই বৈষম্য শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস, সাধারণ জ্ঞান এবং সামগ্রিক শিক্ষাগত কৌতূহলকে প্রভাবিত করে।
পুষ্টি ও স্বাস্থ্য কর্মসূচি
সরকার স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করলেও শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে এর কার্যকারিতা ও ধারাবাহিকতা ভিন্ন। শহরের স্কুলগুলোতে প্রায়ই ভালভাবে বাস্তবায়িত পুষ্টি কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা থাকে। গ্রামীণ এলাকায়, এই কর্মসূচিগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ বা অপর্যাপ্ত হতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, উপস্থিতি এবং ক্লাসে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
শিক্ষণের ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা
শিক্ষণের মাধ্যম ও পাঠ্যক্রমের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। প্রায়ই শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ডিজাইন করা মানসম্মত পাঠ্যক্রম গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জীবন অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এই বিচ্ছিন্নতা গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের বোধগম্যতা ও প্রয়োগে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
শিক্ষায় প্রযুক্তির সংযোজন
শহর ও গ্রামের স্কুলগুলোর মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন ক্রমশ বেশি প্রকট হচ্ছে। শহরের স্কুলগুলোতে কম্পিউটার ল্যাব, ইন্টারনেট সংযোগ এবং শিক্ষামূলক প্রযুক্তির সংস্পর্শ থাকার সম্ভাবনা বেশি। গ্রামীণ স্কুলগুলোতে প্রায়ই এই সম্পদগুলোর অভাব রয়েছে, যা একটি ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিশ্বে তাদের শিক্ষার্থীদের অসুবিধার মধ্যে ফেলছে।
নীতিগত সুপারিশ
এই বৈষম্য মোকাবেলায় বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের বিবেচনা করা উচিত:
- গ্রামের স্কুলগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি গ্রামীণ শিক্ষা উন্নয়ন তহবিল প্রতিষ্ঠা করা।
- দূরবর্তী এলাকায় নিয়মিত পেশাগত উন্নয়ন প্রদানের জন্য মোবাইল শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইউনিট তৈরি করা।
- শহর ও গ্রাম উভয় প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করে এমন একটি সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল পাঠ্যক্রম তৈরি করা।
- গ্রামীণ এলাকায় অতিরিক্ত শিক্ষা সম্পদ প্রদানের জন্য কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা।
- গ্রামীণ অঞ্চলে স্কুল স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করা।
- গ্রামীণ স্কুলগুলোতে প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার উন্নত করতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব শুরু করা।
0 Comments